ভিটামিন এ: উপকার, উৎস, মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া - Vitamin A Benefits, Sources, Dosage & Side Effects in Bengali

ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, ভিটামিন এ সঠিক দৃষ্টিশক্তির জন্য অপরিহার্য। এর অভাব বিভিন্ন চোখের সমস্যা, বিশেষ করে চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া এবং রাতে কম দেখা হতে পারে। ভিটামিন এ ক্যারোটিনয়েডস দিয়ে তৈরি, যা তাদের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণ এবং দেহের প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়।

বয়সের বৃদ্ধির সাথে সাথে জৈব অক্সিডেশানের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং দৃষ্টিশক্তি প্রভাবিত হয়।  ভিটামিন এ'র সম্পূরকতা বয়সের সাথে সম্পর্কিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশান (ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়া) হ্রাস করতে পরিচিত, যা বয়স বৃদ্ধি হলেও ভাল দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে। ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ খাদ্যগুলি ভিটামিন এ'র সম্পূরকগুলির চেয়ে আরও কার্যকর বলে মনে করা হয়।

বয়সের অগ্রগতি ছাড়াও ভিটামিন এ সবাইর দৃষ্টিশক্তির উপরে উপকারী প্রভাব ফেলতে পারে। এটি রেটিনাল ডিজেনারেশান (রেটিনাতে কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া) হ্রাসে সহায়তা করে, যা অন্ধত্বের জন্য দায়ী। গর্ভাবস্থায় এই ভিটামিন দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে বজায় রাখা প্রয়োজনীয়। গর্ভধারণের সময় ভিটামিন এ'র অভাব শিশুদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। যাইহোক, সম্পূরক গ্রহণ করা নাও হতে পারে, কারণ তারা একই ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

রাত-কানা রোগ চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রথম লক্ষণ। এর কারণ হল রেটিনাইটিস পিগমেন্টোসা (বংশানুক্রমিক রোগের একটি গ্রুপ)। চোখের রেটিনা'র কাজ হল আলোক সংকেতকে দৃশ্যে রূপান্তর করা। এই রোগে কিশোর বা যুবক বয়সে রেটিনা নষ্ট হতে শুরু করে। তারপরে প্রভাবিত ব্যক্তিরা 40 বছর বয়সের মধ্যে অন্ধত্বের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

এটি একটি বংশানুক্রমিক ব্যাধি এবং এটি সন্তানদেরও হতে পারে। অতএব, এটি খুবই জরুরী যে এই অবস্থাকে এড়ানো প্রয়োজন। যেহেতু এই রোগের চিকিৎসা সব সময় সফল হয় না, তাই খাদ্যের সাথে ভিটামিন এ যোগ করে ঝুঁকি কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি প্রায়ই বলা হয় যে ভিটামিন এ হল রেটিনা'র (এবং দৃষ্টি) জ্বালানী, তাই এটি ভর্তি করুন!

ভিটামিন এ এপিডারমিস'এর (ত্বকের শীর্ষতম স্তর) একটি সাধারণ উপাদান এবং ত্বকের পুরানো কোষগুলি সরিয়ে নতুন কোষের জন্মে এর একটি ভূমিকা আছে। শিশু এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে পুরানোর বদলে নতুন কোষের জন্মের হার খুব বেশি থাকে, বয়সের সাথে সাথে এই হার কম হতে থাকে। ফলে চামড়া কুঁচকে যায় এবং এতে বয়সের ছাপ পড়ে যায়।

ভিটামিন এ ত্বকের কোষগুলির গঠন এবং বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা মুখের উপর সূক্ষ্ম বলি রেখা এবং কুঞ্চন হ্রাস করতে সহায়তা করে। যেহেতু এপিডারমিস'এর ভিটামিন এ এই প্রক্রিয়ার জন্য অত্যাবশ্যক, তাই তার পরিমাণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে চিকিৎসা অত্যন্ত উপকারী। স্থানীয় ভাবে ত্বকে প্রয়োগ করা জন্য রেটিনয়েড'এর দ্রবণ এমনই একটি বিকল্প।

ভিটামিন এ ফ্রি র‍্যাডিকেল দ্বারা সৃষ্ট অক্সিডেটিভ ক্ষতি হ্রাস এবং ইউভি রশ্মির দ্বারা ত্বকের ক্ষতি হ্রাস করে। ইউভি রশ্মি আবার এপিডারমাল ভিটামিন এ'র মাত্রা কমায়। কাজেই সরাসরি সূর্যালোক থেকে ত্বককে রক্ষা করতে পারলে ত্বকের ক্ষতি হ্রাস হবে। ত্বকে লাগানোর রেটিনইড এজেন্ট হিসাবে, রেটিন্যাল্ডিহাইড বা রেটিনল'এর মত প্রাকৃতিক রেটিনইক অ্যাসিড'এর পূর্বপুরুষগুলি আরও উপকারী এবং অ্যাসিডিক রেটিনইডগুলির তুলনায় কম বিরক্তিকর হয়।

তবে, দৃঢ় ভাবে সুপারিশ করা হচ্ছে যে আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ না করে ব্যবহার করা উচিৎ হবে না। বাজার-চলতি কিছু ক্রিম এবং ময়েশ্চারাইজার, যাতে ভিটামিন এ দেওয়া আছে, ব্যবহার করা যেতে পারে।

ভিটামিন এ কোষের বৃদ্ধি, পৃথকীকরণ, বিস্তার এবং অ্যাপোপটোসিস'এর (কোষের স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত মৃত্যু) জন্য অপরিহার্য। এটি অর্গানোজেনেসিসের প্রক্রিয়া (শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন) নিয়ন্ত্রণ করে এবং এটি দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় শ্লেষ্মার ক্রিয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সব কারণে, এটি কর্কট রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট বিপাকীয় রোগের চিকিৎসায় জন্য ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খেলে, ক্ষেত্রে কর্কট রোগে ঝুঁকি কম থাকে। এই গবেষণাগুলি পরামর্শ দিচ্ছে যে ক্যারোটিনয়েড নির্দিষ্ট কয়েকটি ধরণের কর্কট রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে, তবে মিশ্র ফলাফলও প্রাপ্ত হয়েছে। কিছু ধরনের কর্কট রোগে ঝুঁকি এই সম্পূরকগুলির সাথে বৃদ্ধি পায়, সুতরাং, তাদের ভূমিকা এখনও বিতর্ক-যোগ্য।

আগেই বলা হয়েছে যে গর্ভাবস্থায় ভিটামিন এ'র প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়, ফলে এই অবস্থায় শরীরে ভিটামিন এ'র অভাব ঘটতে পারে। এই অভাবের কারণে নবজাতকের জন্ম-ত্রুটি হতে পারে। ভ্রূণের ত্রুটি ছাড়াও, ভিটামিন এ'র অভাব হলে সঠিক সময়ের আগেই (নির্ধারিত 39-40 সপ্তাহের আগে) শিশুর জন্ম হতে পারে। এতে নবজাতকের স্বাস্থ্য খারাপ হল এবং তাদের জীবিত থাকাই সমস্যা হতে পারে। এই ধরণের শিশুরা সর্বদাই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে থাকে এবং এদের শিখবার ক্ষমতা কম থাকে। এই অবস্থা তাদের বড় হয়ে ওঠা অবধি চলতে থাকে।

কাজেই গর্ভাবস্থায় খাদ্যের সাথে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে, যাতে আর কোন সম্পূরকের প্রয়োজন না হয়। কারণ সম্পূরকগুলির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যে খাদ্যগুলিতে ভিটামিন এ বেশি আছে, সেইগুলি বেশি করে খেলেই হল। শিশুর স্বাস্থ্যকে সুরক্ষা দেওয়া ছাড়াও ভিটামিন এ রক্তাল্পতা এবং উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার প্রবণতার প্রতিরোধ করতে পারে, ফলে মায়ের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়।

গর্ভাবস্থার সময়ে এবং শিশুকে স্তন্যদান করার সময়ে ভিটামিন এ'র আরও উপকার আছে। একটি গবেষণা অনুসারে, অতিরিক্ত মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনের ফলে স্তন অতি সংবেদনশীল হয়, স্তনে ফোলা এবং পিণ্ডাকার বস্তু থাকতে পারে। এই গবেষণাটি জানাচ্ছে যে গাজরের পুলটিস দিলে স্তনের এই সমস্যাগুলির সমাধান হয়। আবার অন্য গবেষণা জানাচ্ছে সে স্তনের এই সমস্যাগুলি নিজে থেকেই কমে যায়, কাজেই গাজরের পুলটিসের কোন অবদান নেই।

(আরও পড়ুন: স্তনে পিণ্ড হয় কেন)

শিশু এবং কিশোরদের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য ভিটামিন এ অত্যাবশ্যক। শৈশবে সংক্রমণ এবং অসুখ দূর করতে ভিটামিন এ সাহায্য করে। শিশু ও কিশোরদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় অনেক সমস্যার ঝুঁকি হ্রাস করে ভিটামিন এ।

সে সমস্ত শিশুরা শক্ত খাবার খেতে শুরু করেছে তাদের খাদ্যে ভিটামিন এ'র সম্পূরক দেওয়া যেতে পারে। তবে মায়ের খাদ্যের মাধ্যমে শিশুদের দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ মজুত রাখতে হবে। কাজেই স্তন্যদাত্রী মা'দের ক্ষেত্রে দৈনিক ভিটামিন এ'র প্রয়োজনীয় মাত্রা বেশি হয়। সুপারিশ করা হচ্ছে যে স্তন্যদাত্রী মা'দের দৈনিক অন্তত 1300 মাইক্রোগ্রাম রেটিনল সমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে যাতে তাদের স্তন্যের দুধে ক্যারোটিনয়েড'এর পরিমাণ বেশি থাকে।

স্তন্যদাত্রী মা'দের খাদ্যে ভিটামিন এ'র সম্পূরক যোগ দিলে শিশুদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্রিয়া উন্নত হয়। উচ্চ মাত্রায় দিলেও শিশুদের কোন ঝুঁকির কথা জানা যায় না, তবে 3000 মাইক্রোগ্রাম'এর অধিক মাত্রা এড়াতে হবে।

মস্তিষ্কের জন্য ভিটামিন এ অপরিহার্য। জীবনের প্রতিটি ধাপেই মস্তিষ্কের উপরে এর প্রভাব অনুভব করা যায়। শিশু এবং কিশোরদের জীবনে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, কারণ এই ভিটামিনটি মস্তিষ্কের কোষের সঠিক বৃদ্ধি, বিকাশ এবং পৃথকীকরণে সহায়তা করে। এর ফলে বয়স বাড়লেও মস্তিষ্কের সর্বোত্তম কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।

(আরও পড়ুন: দুর্বল স্মৃতি)

একজন বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে কোষের পৃথকীকরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু পরিবর্তন সম্ভব, যাকে 'নিউরাল প্লাস্টিসিটি' বলা হয়। এই নিউরাল প্লাস্টিসিটি বয়স্কদের স্মৃতি এবং অন্যান্য কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এ'ছাড়াও 'সারকাডিয়ান রিদম' বজায় রাখতেও ভিটামিন এ সাহায্য করে, সারকাডিয়ান রিদম ঘুম এবং ক্ষুধার চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা উন্নত করতে খাদ্যের সাথে ভিটামিন এ গ্রহণ করা ভাল। সারকাডিয়ান ঘড়ি নিয়ন্ত্রণে, শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়া উন্নত করতে এবং ঘুম-চক্র নিয়ন্ত্রণ করতে ভিটামিন এ সহায়তা করে।

(আরও পড়ুন: অনিদ্রার কারণ)

হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগ, যা টিকা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ভারতে এই রোগ ছড়িয়ে আছে। এটি একটি গুরুতর ভাইরাস সংক্রমণের অসুখ এবং এতে শিশুদের মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে। ভারতে প্রতি বছর 5000'এরও বেশি হাম রোগের খবর নথিবদ্ধ হয়। ভিটামিন এ'র অভাব আছে এমন অপুষ্ট শিশুদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।

অপুষ্টির শিকার এই বাচ্চাদের ইন্ট্রা-মাসকুলার ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে ভিটামিন এ প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে দেখা গিয়েছে যে হাম রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। এদের মধ্যে মৃত্যুর হার কমেছে এবং বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।

(আরও পড়ুন: সংক্রমণের চিকিৎসা)

ভিটামিন এ'র সম্পূরক বয়স্কদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হওয়ার কারণে ভিটামিন এ ত্বকের উপরে বয়সের চিহ্নগুলি হ্রাস করে। বয়স বাড়লেও ভিটামিন এ ত্বককে দৃঢ় এবং নমনীয় রাখে।

বয়স্কদের দৃষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা এবং চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে। এ'ছাড়াও অক্সিডেটিভ চাপ হ্রাস করে বয়স্কদের চেতনার বিশৃঙ্খলা (মস্তিষ্কের কাজ এবং স্মৃতি সংক্রান্ত) প্রতিরোধ করে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতি-ভ্রংশ হওয়া এবং চেতনা বিশৃঙ্খলা হওয়ার মূলে আছে অক্সিডেটিভ চাপ। কাজেই বয়স্কদের মানসিক এবং দৈহিক কাজকর্ম উন্নত করতে ভিটামিন এ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।