হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম কি?
আমাদের ঘাড়ে যে থাইরয়েড গ্রন্থি রয়েছে, তার কাছাকাছি চারটি ছোটো ছোটো গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি থাকে, এদের প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি বলে। এদের কাজ হলো প্যারাথাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ করা। এই প্যারাথাইরয়েড হরমোন শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ও তা বজায় রাখে। হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম হলো প্যারাথাইরয়েড গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি যে প্যারাথ্রোমোন হরমোন উৎপাদন করে, তার অপর্যাপ্ততা অর্থাৎ প্যারাথ্রোমোন হরমোন স্বাভাবিক মাত্রায় উৎপন্ন না হওয়া। এর ফলে রক্তে ক্যালিসিয়ামের মাত্রা কমে যায়, একে হাইপোক্যালসেমিয়া বলে। অন্যদিকে, রক্তে ফসফরাস সিরামের মাত্রা বেড়ে যায়, একে বলে হাইপোফসফেটেমিয়া।
এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজমের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেওয়ার কারণ হলো রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা হ্রাস পাওয়া।
- এই উপসর্গের ফলে মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের তীব্রতার যেসব ইঙ্গিত দেখা যায়:
- ঝিনঝিন করা।
- পায়ের পাতা, হাতের আঙুল এবং ঠোঁটের চারপাশে অসাড়ভাব ও প্যারাসথেসিয়া (অস্বাভাবিক অনুভব)।
- পেশীতে ব্যথা।
- সাধারণ দুর্বলভাব।
- মাথাব্যথা।
- উদ্বিগ্নতা অথবা স্নায়বিক দুর্বলতা বোধ।
- শুকনো ও খসখসে চামড়া।
- বেশ কিছুটা মাথার চুলে উঠে যাওয়া।
- ভঙ্গুর নখ।
- মানসিক অবসাদ।
- গুরুতর রোগের উপসর্গের ইঙ্গিতের মধ্যে রয়েছে:
- পেশীতে খিঁচুনি ধরা আর তার থেকে ল্যারিঙ্গোস্প্যাজম (ভোকাল কর্ড বা কণ্ঠনালিতে খিঁচুনি ধরা) অথবা ব্রঙ্কোস্প্যাজম (ফুসফুসের বায়ুপথ যে টিস্যু বা তন্তু দিয়ে ঢাকা থাকে, তাকে ব্রঙ্কি বলে। সেই ব্রঙ্কিতে খিঁচুনি ধরা)।
- পেশীতে টান ধরা।
- সমস্যা দীর্ঘস্থায়ি হলে যেসব অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে:
- দাঁতের বিকাশে অসঙ্গতি। শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয়, একে এনামেল হাইপোপ্লাসিয়া বলে।
- দাঁতের গোড়ায় বিকৃতি।
- দাঁতে গর্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি।
- কর্কশ গলার স্বর।
- শ্বাস নেওয়ার সময় সাঁইসাঁই আওয়াজ।
- ডিস্পনিয়া (শ্বাসকষ্ট)।
- তড়কা লাগা বা খিঁচুনি ধরা।
- মূর্ছা যাওয়া বা জ্ঞান হারানো।
- কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া (বেশ কয়েকটি সমস্যার সমন্বয়, যার ফলে হৃদস্পন্দনের ছন্দে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় – কখনও প্রচণ্ড দ্রুত, কখনও খুব ধীরগতি, আবার কখনও অনিময়িতভাব)।
- আবছা দেখা বা চোখে ছানি।
এর প্রধান কারণ কি?
হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজমের কারণ হলো প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির কম পরিমাণে প্যারাথাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ করা।
- সাধারণ কারণ:
- থাইরয়েড অপারেশন অথবা গলা বা ঘাড়ে অস্ত্রোপচার করার সময় প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থিতে আঘাত লাগা অথবা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে, তা বাদ দেওয়া।
- অন্যান্য কারণ:
- হাইপারথাইরয়েডিজমের জন্য রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন থেরাপি দেওয়ার ফলে পরোক্ষে ক্ষতি।
- ডিজর্জ সিন্ড্রোম, অ্যাড্রিনাল হরমোনের অপর্যাপ্ততা বা অ্যাডিসন রোগের মতো ক্রোমোজোম (জিনগত উপাদান বহনকারী পরিকাঠামো) ঘটিত নানান কারণের সঙ্গে যুক্ত সমস্যা।
- ম্যাগনেসিয়াম রক্ত রস স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যাওয়া।
- অটোইমিউন রোগ (এই ধরণের অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা, তার শরীরেরই কোষ ও টিস্যুগুলিকে নষ্ট করে দেয়)-এর কারণে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির উপর প্রভাব।
- জন্ম থেকেই প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অনুপস্থিতি (একে কনজেনিয়াল হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম বলা হয়)।
কিভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
উপসর্গ, লক্ষণ, বিস্তারিত চিকিৎসাজনিত ইতিহাস এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনার ওপর রোগ নির্ণয় নির্ভর করে।
যেসব পরীক্ষা করা হয়:
- ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রার মূল্যনির্ধারণের জন্য রক্ত পরীক্ষা।
- প্যারাথাইরয়েড হরমোন টেস্ট বা পরীক্ষা।
- ক্যালসিয়াম কতোটা পরিমাণে শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য মূত্র পরীক্ষা।
- হৃদযন্ত্রের ছন্দ দেখার জন্য ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ই সি জি) এবং ছানি হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য চিকিৎসক কোনও ভালো চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম রোগের চিকিৎসার লক্ষ্য হলো উপসর্গ উপশম করা এবং হাড় ও রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রার ভারসাম্য পুনরায় ফিরিয়ে আনা। অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি:
- ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি’র জন্য বিকল্প ওষুধ খাওয়া এবং সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
- প্রয়োজনে প্যারাথাইরয়েড ইঞ্জেকশন দেওয়া হতে পারে।
- গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম সরাসরি ধমনীতে প্রবেশ করানো হয় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে।
- কঠিন সমস্যার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলি (রক্তচাপ, হৃদগতি, শ্বাস নেওয়ার গতি ও শরীরের তাপমাত্রা) এবং হৃদস্পন্দনের ছন্দের ওপর ভালোমতো খেয়াল রাখতে হয়।