আবেটলিপোপ্রোটিনেমিয়া কি?
আবেটলিপোপ্রোটিনেমিয়া হলো এক ধরণের বিরল অসুখ। অসুখটি পুরোপুরি জিন ঘটিত সমস্যা, এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীর ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবারের উপাদান এবং তার মধ্যে দ্রবীভূত ভিটামিন শোষণ করতে পারে না। আক্রান্ত রোগীর শরীরে কোলেস্টেরল মাত্রাও স্বাভাবিক থাকে না। রোগীর অন্ত্র ফ্যাট শোষণ করতে না পারায়, শরীরে লিপিড ও কিছু ভিটামিনের অভাব দেখা দেয়।
এই অসুখটি ব্যাসন-কর্নজওয়াইগ সিন্ড্রোম নামেও পরিচিত। এই নামটি সেই ডাক্তারের নামে রাখা হয়েছে যিনি প্রথম এই রোগটিকে জনসমক্ষে আনেন।
এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
- পরিপাক তন্ত্রের ওপর আবেটলিপোপ্রোটিনেমিয়ার ভীষণভাবে প্রভাব পড়ায় বমি হয়, মলে দুর্গন্ধ হয় এবং বাইরে পেটের অংশ ফেঁপে ওঠে।
- এই রোগের প্রভাব স্নায়ুতন্ত্রের ওপরেও পড়ে। ফলে, শরীরে স্নায়বিক সমন্বয় যেমন ঠিকমতো হতে পারে না, তেমনই ঝিঁঝিঁ ভাব, হাত-পা কাঁপা আর কথার বলার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।
- শরীরের কঙ্কালে একাধিক বিকারগ্রস্ততার পাশাপাশি আক্রান্ত রোগীর শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়াও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে।
- শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা অস্বাভাবিক আকার নেয়। আর তার থেকে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া হয়, যার ফলে ক্লান্তি ও দুর্বলতা দেখা দেয়।
- এর ফলে চোখ এবং লিভারের মতো শরীরের অন্যান্য অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই রোগের প্রধান কারণ কি?
শরীরে একটি নির্দিষ্ট জিনের পরিব্যক্তি বা মিউটেশন ঘটলে এই ধরণের অবস্থা তৈরি হয়। মানব শরীরের স্বাভাবিক জিনগত বিন্যাসে পরিবর্তন বা রূপান্তর হলে তাকে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি বলে। এর ফলে, মানব শরীরে বিকার বা অসুখ দেখা দেয়। এটি একটি অটোসোমাল রিসিসিভ ডিসঅর্ডার, যাতে শিশু আবেটলিপোপ্রোটিনেমিয়া রোগটি তার মাতা ও পিতা উভয়ের জিন থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকে।
যে সমস্ত পিতা-মাতারা পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত, তাদের সন্তানদের এই বিরল জিনগত অসুখের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
এই রোগটি কিভাবে নির্ণয় আর চিকিৎসা করা হয়?
কোনও ব্যক্তি এই অসুখে আক্রান্ত কি না, সেটি নির্ণয় করার জন্য বিশেষ টেস্ট বা পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া ছাড়াও, চিকিৎসক উপসর্গের ধরণ আর আগে হওয়া চিকিৎসার ইতিহাস এবং পরীক্ষা থেকে একটি নিশ্চিত ধারণায় আসেন।
- রক্তে লিপিড, লাইপোপ্রোটিন ও কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক আছে কি না, তা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। সেই সঙ্গে রক্তে ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই এবং ভিটামিন কে-এর মাত্রা ঠিক আছে কি না, তাও দেখে নেওয়া হয়।
- লোহিত রক্ত কণিকা যদি অস্বাভাবিক আকার নেয়, রক্ত পরীক্ষায় তা ধরে পড়ে যায়।
- উপসর্গের ওপর নির্ভর করে রোগীর স্নায়বিক মূল্যায়ন এবং চোখের পরীক্ষাও করা হয়।
এই অসুখের ক্ষেত্রে বহু-বিষয়ক দৃষ্টিকোণ থেকে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হয়। শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে উপসর্গকে আয়ত্তে আনার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকারী।
- আবেটলিপোপ্রোটিনেমিয়া আক্রান্ত সমস্ত রোগীকেই তাদের খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ দেওয়া হয়। শরীর যেহেতু ফ্যাট জাতীয় খাদ্য থেকে ফ্যাট সংগ্রহ করতে পারে না, তাই খাদ্য তালিকা থেকে ফ্যাট জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ কমানো হয়।
- ফ্যাটে দ্রবীভূত ভিটামিনের সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়, যাতে এই রোগের ফলে শরীরে যে স্নায়বিক ও চোখের অসুখের উপসর্গ দেখা দেয়, তা কমে যায়।
- নিউরোমাসকিউলার সমস্যায় ফিজিওথেরাপি এবং পেশী সংক্রান্ত ব্যায়াম উপকারী।
- কোনও দম্পতির প্রথম সন্তানের যদি এই সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে পরবর্তী সন্তানকে জন্ম দেওয়ার আগে জেনেটিকাল কাউন্সেলিং করানো অবশ্যই জরুরি।
- প্রাথমিক অবস্থায় যদি এই অসুখ ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসার ফল ভালো হয়। এই অসুখের ফলে জীবনের গুনগত মানে যে হ্রাস হয়, সময়ে চিকিৎসা করালে, তা ঠেকানো যায়।