কুশিং সিন্ড্রোম (কুশিং বর্ণিত রোগ) কি?
কুশিং সিন্ড্রোম বা কুশিং বর্ণিত রোগ একটি হরমোন ঘটিত রোগ, যা শরীরে কর্টিসল হরমোনের অনিয়মিত ক্ষরণের জন্যে (স্বাভাবিক কর্টিসল স্তরের চেয়ে বেশী) হয়। কর্টিসলকে “স্ট্রেস হরমোন” বলা হয় কারণ অধিক মানসিক চাপের সময় এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এর কারণ অভ্যন্তরীণ (শরীরের ভেতরের কোনো সমস্যার কারণে) বা বাহ্যিক (পারিপার্শ্বিক থেকে উদ্ভূত কোনো কারণ) হতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্ব জুড়ে প্রতি মিলিয়ন মানুষের মধ্যে 40 থেকে 70 জনের এই রোগ আছে। জনগণনার বিচারে দেখা গেছে যে ভারতে প্রতি মিলিয়ন মানুষের মধ্যে প্রতি বছরে 0.7 থেকে 2.4 জনের এই রোগ হয়ে থাকে।
এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
চিকিৎসাগত বৈশিষ্ট্যগুলি বিভিন্ন হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী উপসর্গগুলি হল:
- স্থূলতা, সাধারণত শরীরে ওপর দিকে দেখা যায়
- মুন ফেস বা চাঁদের মতো গোল পেশীবহুল মুখ
- ষাঁড়ের মতো পিঠে কুঁজ হওয়া
- অনিয়মিত মাসিক
- যৌন সঙ্গমের ইচ্ছা কমে যাওয়া
- অবসাদ
- সাইকোসিস (একটি মারাত্মক মানসিক অসুখ)
- সর্বাঙ্গীন জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি সম্বন্ধনীয় অসুস্থতা
- শিথিল পেশী
- হাড়ে চির ধরা
- শিশুদের অনিয়মিত বৃদ্ধি
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, সাধারণত 30 থেকে 50 বছর বয়সের মধ্যে এই রোগ দেখা যায় কিন্তু শিশুদেরও এই রোগ হতে পারে। পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে এই রোগের আধিক্য অনেক বেশি (মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে অনুপাত 3:1)। কিছু বিরল লক্ষণ হল:
অন্য যে রোগে একই উপসর্গগুলি দেখা যায় (অন্যান্য রোগ):
- পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (পিসিওডি)।
- বিপাকক্রিয়াজনিত উপসর্গ (অনেকগুলি শারীরিক অসুবিধার সমন্বয় যেগুলি হৃদরোগের সৃষ্টি করে)।
এই রোগের প্রধান কারণগুলি কি কি?
এই রোগ হওয়ার প্রধান কারণ হল বেশি মাত্রায় কর্টিসল ব্যবহার, বিশেষতঃ গ্লুকোকর্টিকোয়েডস ঘনঘন ব্যবহার করা। কর্টিসল নিম্নলিখিত কিছু কারণে খুবই প্রয়োজনীয়:
- রক্তের চাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখে
- প্রদাহজনক শারীরিক অসুবিধাগুলি কমিয়ে রাখে
- খাদ্যকে শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তিতে পরিবর্তিত করে
যাইহোক, এর অসামঞ্জস্য শরীরে কর্টিসলের মাত্রাকে অস্বাভাবিক করে তোলে যা ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করে। এটি অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক প্রকারের হতে পারে (দীর্ঘ সময় ধরে কর্টিকোস্টেরয়েডস সেবন করা)।
অন্যান্য কারণগুলি হল:
- পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার
- এক্টোপিক টিউমার যা এসিটিএইচ হরমোন উৎপাদন করে
- আড্রিনাল গ্রন্থিতে টিউমার
এই রোগ কিভাবে নির্ণয় করা হয় ও এর চিকিৎসা কি?
রোগ নির্ণয় মূলত করা হয় এই উপায়গুলির উপর ভিত্তি করে:
- চিকিৎসাজনিত ইতিহাস।
- শারীরিক পরীক্ষা।
- ল্যাবরেটরিতে বা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা।
প্রদাহনাশক হিসেবে, অটোইমিউন, এবং নিওপ্লাস্টিক (টিউমার) রোগের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ গ্লুকোকর্টিকোয়েডস ব্যবহৃত হয়। অতএব, রোগীর সঠিক চিকিৎসাজনিত ইতিহাস জানা সাধারণত দরকার। রোগ নির্ধারণ করার জন্যে আর যা যা পরীক্ষা করা হতে পারে:
- টানা 24 ঘন্টা কর্টিসলমুক্ত মূত্র তৈরী হচ্ছে কিনা (ইউএফসি)।
- গভীর রাতে মুখের লালারসে কর্টিসলের উপস্থিতি।
- কম-মাত্রায় ডেক্সামেথাসন সাপ্রেশন টেস্ট (এলডিডিএসটি)।
- সারারাত্রি ব্যাপী ডেক্সামেথাসন সাপ্রেশন টেস্ট (ওএনডিএসটি)।
- অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির সিটি স্ক্যান।
কুশিং বর্ণিত রোগের জন্য দায়ী হতে পারে এমন অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বার করতে যে পরীক্ষাগুলি করা হয়:
- কর্টিকোট্রোপিন-ক্ষরণকারী হরমোনের পরীক্ষা (সিআরএইচ)।
- অধিক-মাত্রায় ডেক্সামেথাসন সাপ্রেশন পরীক্ষা (এইচডিডিএসটি)।
- বাইল্যাটার্যাল ইনফেরিয়র পেট্রোসাল সাইনাস স্যাম্পলিং (বিআইপিএসএস)।
কুশিং সিনড্রোমের চিকিৎসা পদ্ধতি:
- চিকিৎসাজনিত থেরাপি: রোগ সৃষ্টিকারী অভ্যন্তরীণ কারণের উপর নির্ভর করে নিম্নলিখিত ওষুধগুলি প্রয়োগ করা হয়:
- স্টেরোয়েড তৈরী হওয়া বন্ধ করা।
- গ্লুকোকর্টিকোয়েড রিসেপ্টর ইনহিবিটর।
- এসিটিএইচ মোচন নিয়ন্ত্রণ করা।
- অ্যাড্রেনোলাইটিক ওষুধ।
- যদি কোনো ব্যক্তি আগে থেকেই কর্টিসল সেবন করে থাকেন, তাহলে উপসর্গগুলি হ্রাস করতে তাকে আগের চেয়ে কম মাত্রার কর্টিসল খেতে বলা হয়।
- অস্ত্রোপচার:
- টিউমার্ অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া বা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হতে পারে।
- পিটুইটারি গ্রন্থিতে রেডিওথেরাপি।
নিজের যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি:
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া।
- ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করা, কারণ এই অভ্যাসগুলি রোগটিকে আরো জটিল করে তোলে।
- সুষম আহার করুন, দরকার হলে খাদ্যতালিকা বিশারদের পরামর্শ নিন।
- নিয়মিত হালকা শরীরচর্চা করুন, কারণ কষ্টকর ও কঠিন ধরণের শরীরচর্চায় বা খেলাতে এই রোগে আক্রান্তদের হাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ধকল ও মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন, কারণ বেশি চাপের মধ্যে থাকলে কর্টিসল বেশি ক্ষরণ হয়।
উপরের নিয়মগুলি মেনে চললে কুশিং বর্ণিত রোগ বা কুশিং সিন্ড্রোমের প্রভাব আয়ত্তের মধ্যে রাখা যায় এবং দরকার মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।